বাংলা নিয়ে পড়ে চাকরি পাওয়ার সুযোগ কী কী?
দশম শ্রেণীর পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই উচ্চশিক্ষার বিভাগ বাছতে গিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা। চাকরির বাজারে বিজ্ঞান, বাণিজ্য বিভাগের তুলনায় কলা বিভাগের চাহিদা সব সময় কম এই ধারণার বশবর্তি হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কলা বিভাগের অন্যান্য বিষয় বিশেষত মাতৃভাষা হিসাবে বাংলা নিয়ে পড়ার প্রতি অনীহা দেখা যায়। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে প্রায় সমস্ত বিদ্যালয়ে প্রায় ১২ বছর প্রথম ভাষা হিসেবে বাংলা পড়তে হয়। তবুও যদি বলা হয় কেন আমরা ভাষা শিক্ষা করি কেউই তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারি না।
আসলে ভাষা শিক্ষার প্রধান কাজ হল যোগাযোগ, যেটা বাংলা বা যেকোনো অন্যান্য ভাষা হতে পারে। পড়াশোনার বিভিন্ন শাখার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে ভাষা আমাদের শিখতেই হয়। কারণ ভাষা শিক্ষা ছাড়া আমরা কোন বিষয়কেই ঠিকমত জানতে পারবো না। আর এই ভাষাকে যখন আমরা বিষয় হিসেবে উচ্চ শিক্ষার জন্য বেছেনি তখনই সেটা হয়ে ওঠে সাহিত্য।
সাহিত্য মানুষকে কল্পনাপ্রবন, অনুভূতি প্রবণ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। সাহিত্য মানুষের মধ্যে যুক্তিবদ্ধ তুলনা করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
এই সমস্ত তথ্য জানা সত্ত্বেও বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বাংলা ভাষা নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে অনীহা দেখা যায় কারণ চাকরির সুযোগের অপ্রতুলতা। তবুও তারই মধ্যে বেশকিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী বাংলা নিয়ে উচ্চ শিক্ষাতে আগ্রহী হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তবুও সাধারণ মানুষ বলে থাকেন বাংলা নিয়ে পড়লে চাকরির সুযোগ থাকে না। কিন্তু চারিদিকে একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে বাংলা নিয়েও চাকরির সুযোগ প্রচুর।
কারা বাংলা নিয়ে পড়তে পারে?
বিজ্ঞান/ বাণিজ্য/ কলা বিভাগে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নম্বর প্রয়োজন হয় দ্বাদশ শ্রেণীতে ,বাংলায় স্নাতক পড়ার জন্য ।দ্বাদশ শ্রেণীর পাশের পর আসে কলেজে ভর্তির পালা। আমাদের রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোতে বাংলা তে স্নাতক নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দ্বাদশ শ্রেণীর মেধার তালিকার উপর নির্ভর করে ভর্তি নেয় আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব প্রবেশিকা পরীক্ষা থাকে। এরপর যদি শিক্ষার্থীরা উচ্চতর শিক্ষা লাভ করতে চায় তারা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে পারে অথবা নেট, সেট পরীক্ষা দিয়ে গবেষণার সুযোগও পেতে পারে।
বাংলায় উচ্চশিক্ষাতে কি পড়ানো হয়?
বাংলা বিভাগগুলিতে যা পড়ানো হয় তা প্রধানত সাহিত্য নির্ভর এখানে প্রাচীন মধ্য ও আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিকদের লেখা বাংলা গল্প উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি পড়তে হয়। এছাড়াও প্রাচীন যুগের চর্যাপদ, মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য বৈষ্ণব কবিতা, বৈষ্ণব পদাবলী ইত্যাদি পড়তে হয়। শ্রীচৈতন্য প্রণয় উপাখ্যান সম্বন্ধে বিস্তারিত পড়াশোনা করতে হয়। তাছাড়াও কালিদাস, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং সমস্ত আধুনিক যুগের সমস্ত লেখক এবং কবিদের লেখাকে বিশদভাবে জানতে হয় কিছু বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদ ও তার সাথে পড়তে হয়। বাংলা বাংলা কবিতা অলংকার বাংলা ভাষার ইতিহাস, সাহিত্য সমালোচনা ইত্যাদিকে বিশদভাবে শিখতে হয় ছাত্রছাত্রীদের কে।
বাংলা পড়ে কি কি চাকরির সুযোগ পাওয়া যায়?
এবার আসি প্রধান বিষয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়লে কি কি চাকরির সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে প্রথমেই আসেঃ-
১) শিক্ষকতা-
প্রাথমিক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষকতার সুযোগ ছাড়াও থাকে কলেজেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগও। ছাত্রছাত্রীরা চাইলেও উচ্চতর গবেষণার দিকেও তারা যেতে পারে তবে শিক্ষকতার জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছাড়াও বিএড বা ডি এল এড ডিগ্রী দরকার হয়।
২) লেখক-
বাংলা নিয়ে উচ্চশিক্ষা মানেই ধরে নিতে পারি তার ভাষা ও লেখার দক্ষতা ভালো হবে। তাই লেখালেখির যদি ইচ্ছা থাকে সহজে লেখক হওয়ার দিকে এগোনো যেতে পারে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সামাজিক মাধ্যমে গল্প উপন্যাস দিয়ে লেখালেখি শুরু করা যেতেই পারে। বর্তমান যুগে সামাজিক মাধ্যমে নিজের পেজ বানিয়ে ধীরে ধীরে লেখালেখির চেষ্টা করে রোজগার করার চেষ্টা করা যেতেই পারে। বর্তমান সময়ে বাড়িতে বসে কাজ করে রোজগার করার এটি একটি খুব ভালো সুযোগ।
৩) প্রকাশনা সংস্থা-
যেকোনো প্রকাশনার সংস্থাতে প্রুফ রিডারের কাজ পাওয়া যেতে পারে বাংলা নিয়ে পড়ে।
8) চিত্রনাট্য লেখা-
যেকোনো বাংলা প্রোডাকশন হাউস বা মিডিয়া হাউসে চিত্রনাট্য লেখার কাজ পাওয়া যেতে পারে।
৫) অনুবাদক-
বিভিন্ন ভাষার বই, লেখা থেকে বাংলায় অনুবাদ করার কাজ পাওয়া যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে যে ভাষা থেকে অনুবাদ করা হবে সে ভাষা সম্পর্কেও জ্ঞান থাকতে হবে।
৬) ভাষাতাত্ত্বিক-
কাজ করা যেতে পারে, ভাষাতাত্ত্বিক হিসাবে। এই বিভাগে বাংলা নিয়ে কাজ করার সুযোগ প্রচুর। বাংলার ইতিহাস বাংলা ভাষার স্তরবিন্যাস ইত্যাদি নিয়ে কাজ করার সুযোগ মেলে এই বিষয়ে।
৭) বিজ্ঞাপন বিভাগ/সংবাদ সংস্থা-
ভাষায় ভালো দক্ষতা থাকলে বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলিতে কাজ পাওয়া যেতে পারে খুব সহজেই। যদি কবিতা লেখার প্রতিভা থাকে তাহলে বিজ্ঞাপন সংস্থার ট্যাগ লাইন লেখক হিসেবেও মিলতে পারে কাজ। এছাড়া বর্তমান যুগের সমস্ত সংবাদ সংস্থা তে বাংলা ভাষার চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে সংবাদ পাঠ, সংবাদ সংগ্রহকারী, সংবাদদাতা এবং সম্পাদকের পদেও মিলতে পারে কাজ। তবে এই ক্ষেত্রে সংবাদের দুনিয়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা খুবই দরকার।
৮) কনটেন্ট রাইটার/ডিজিটাল মার্কেটিং-
যে কোন এডুকেশন ফার্মে বা ওয়েবসাইট ডিজাইন কোম্পানিতে, আইটি ফার্মে কনটেন্ট রাইটার, ফ্রিল্যান্স কনটেন্ট রাইটার হিসেবে কাজ করা যেতে পারে। কনটেন্ট রাইটিং পেশাটির ভবিষ্যৎ এই মুহূর্তে খুবই উজ্জ্বল। এছাড়াও ডিজিটাল মার্কেটিং-এর কোর্স করে কোনো ডিজিটাল মার্কেটিং ফার্মে কাজের সুযোগ বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে।
৯) সরকারি চাকরি-
বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসার এবং চাকরি পাওয়ার সুযোগ ,যা শুধুমাত্র বাংলাতেও স্নাতক হলেই বসা যায়।
এবার আমরা এক ঝলকে দেখেনি, কি কি সরকারি চাকরির সুযোগ আছে বাংলা নিয়ে পড়ার পরে।
- সর্বভারতীয় স্তরে আই এ এস/আই পি এস পরীক্ষা দেয়া যায়।
- রাজ্য পুলিশ ,ডাবলু বিসি এস এই পরীক্ষাগুলি দেয়া যায় এর একটা বেশিরভাগ অংশ জুড়েই থাকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য।
- কেন্দ্রীয় রাজ্য গ্রুপ সি, ডি পদে পরীক্ষায় বসা যায়।
- খুব ভালো নম্বর থাকলে ভারতীয় ডাক বিভাগের পরীক্ষা তো বসা যায়। ব্যাংক ,মিউনিসিপ্যালিটি অথবা যে কোন অফিসে ক্ল্যারিকাল পোস্ট ,স্কুল ইন্সপেক্টর ইত্যাদি পদেও চাকরির পরীক্ষার জন্য বসা যায় এবং পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করলে চাকরি পাওয়া যায়।
এছাড়াও আছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা, আবৃত্তি,রেডিও জকি, ডিজিটাল মিডিয়াতে নানা রকমের কাজ।
বাংলা অনার্স পড়ে কাজের সুযোগ ও তার বেতন প্যাকেজঃ-
চাকরির ভূমিকা | গড় বার্ষিক বেতন |
বিজ্ঞাপনচিত্র পরিচালক | ভারতীয় মুদ্রায় ৩.৪ লাখ/বছরে |
যাদুঘর পরামর্শদাতা | ভারতীয় মুদ্রায় ৪.৪ লাখ/বছরে |
আর্ট গ্যালারি কিউরেটর | ভারতীয় মুদ্রায় ৪.৮৫ লাখ/বছরে |
দোভাষী | ভারতীয় মুদ্রায় ৫ লাখ/বছরে |
প্রভাষক বা অধ্যাপক | ভারতীয় মুদ্রায় ৪.৫ লাখ/বছরে |
সরকারী অনুবাদক | ভারতীয় মুদ্রায় ৪.১ লাখ/বছরে |
বেসামরিক প্রশাসক | ভারতীয় মুদ্রায় ৫.৮৫ লাখ/বছরে |
পুলিশ | ভারতীয় মুদ্রায় ৮.১ লাখ/বছরে |
সাংবাদিক | ভারতীয় মুদ্রায় ৩.৮ লাখ/বছরে |
সেলসম্যান | ভারতীয় মুদ্রায় ৪.০৬ লাখ/বছরে |
কাস্টমার কেয়ার বিশেষজ্ঞ | ভারতীয় মুদ্রায় ৩ লাখ/বছরে |
বিজ্ঞাপন- কপিরাইটার | ভারতীয় মুদ্রায় ৬.২৪ লাখ/বছরে |
গবেষক | ভারতীয় মুদ্রায় ৬.৯৪ লাখ/বছরে |
স্ক্রিপ্টরাইটার | ভারতীয় মুদ্রায় ৬ লাখ/বছরে |
সবশেষে বলা যায় অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় বাংলায় উচ্চশিক্ষা করা তুলনামূলকভাবে সহজ। তাই ভালো করে বাংলা বিষয়টি রপ্ত করতে পারলে সব বিভাগেই চাকরির সুযোগ রয়েছে সুতরাং বাংলা বিষয় নিয়ে পড়ে কি হবে এমন দুশ্চিন্তা না করাই ভালো।