VJRC Career Guidance Blog

Vijaygarh Jyotish Ray College | Affiliated to the University of Calcutta | NAAC Accredited | ISO 9001:2015 Certified

Inspiration

কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন-এর প্রতিষ্ঠাতা হারল্যান্ড স্যান্ডার্সের জীবনের অবিশ্বাস্য গল্প

সাফল্য লাভের কোন নির্দিষ্ট বয়স হয় না। কঠোর পরিশ্রম ও ইচ্ছাশক্তিই হল সাফল্য লাভের চাবিকাঠি। যেকোন পরিস্থিতিতে দৃঢ় মনোবলের সাথে পরিশ্রম চালিয়ে গেলে সাফল্য ধরা দিতে বাধ্য। তারুন্যে, মধ্য বয়সে আবার কখন কখন জীবনের অন্তিম সময়েও সাফল্য ধরা দিতে পারে। তবে নির্দিষ্ট কোন সময় একজন ব্যক্তির জীবনে সাফল্য লাভ করা সম্ভব হবে তা হয়ত কেবল ঈশ্বরই ঠিক করে দিতে পারেন। জীবনের প্রায় পঁয়ষট্টিটা বছর অতিবাহিত করার পর, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে চিকেন ফ্রাই-এর জিভে জল আনা রেসিপি উদ্ভাবন করে যে ব্যক্তিটি সাফল্যের খাতায় নাম লেখান তিনি হলেন হারল্যান্ড স্যান্ডার্স। হ্যাঁ, এই হারল্যান্ড স্যান্ডার্স-ই হলেন কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন অর্থাৎ KFC-এর প্রতিষ্ঠাতা। KFC-এর লোগোতে যে বয়স্ক মানুষটার ছবি আমরা দেখতে পাই তিনিই হলেন স্যান্ডার্স।

১৮৯০ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে স্যান্ডার্স জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবা ছিলেন কৃষক।যখন স্যান্ডার্সের বয়স মাত্র পাঁচ বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। এর পর থেকেই ভাই- বোনদের দেখাশোনার ও তাদের পড়াশোনার দায়িত্ব পরে তাঁর উপর। তাই শৈশব থেকেই স্যান্ডার্স বুঝে গিয়েছিলেন তাঁর জীবনের চলার পথ মসৃণ নয়। এর মধ্যেই তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর যখন বারো বছর বয়স তখন তাঁর মা পুনরায় বিবাহ করলেন। সৎ বাবাকে একদমই তিনি পছন্দ করতেন না। তাই তেরো বছর বয়সে ঘর ছেড়ে ক্ষেতে শ্রমিকের কাজ করা শুরু করলেন। এর ফলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন তার পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেল।

১৬ বছর বয়সে,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর বয়সের ভুল তথ্য দিয়েছিলেন। একবছর পর তিনি রেলওয়েতে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পান। তবে সহকর্মীর সঙ্গে মারামারির কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।তারপর  ইন্ডিয়ানা পুলিশের ঘোড়ার গাড়িতে রঙ করার কাজ পান তিনি। এই কাজটি বেশিদিন তাঁর ভালো লাগলো না।  স্যান্ডার্স ছোটবেলা থেকেই  অস্থির মনের মানুষ ছিলেন , একটানা কোন কিছুই তাঁর ভালো লাগত না। অল্প সময় যেকোন কাজ করেই তিনি হাঁপিয়ে উঠতেন। কোন কাজই মন দিয়ে বেশিদিন ভালভাবে করতে পারতেন না। রংমিস্ত্রীর কাজ, বাসের কন্ডাক্টর-এর কাজ, কামারশালায় কাজ, কয়লাচালিত ট্রেনের ছাইয়ের ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের কাজ, ফায়ারম্যানের কাজ, দিনমজুরের কাজ ছাড়াও আরও অনেক কিছুই কাজ করেছেন তিনি। কিন্ত কোন কাজেই স্থির হতে পারেননি তিনি।  কম বয়সেই বারবার চাকুরি হারিয়েছিলেন।

মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি বিয়ে করে ফেললেন ও তার পরের বছরে এক কন্যাসন্তানের পিতা হলেন। এরপর তাঁর আরও দুই সন্তানের জন্ম হয়। সেই সময় নির্দিষ্ট কোন চাকরি ও আয় না থাকায় সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়ে। এই অবস্থায় ১৯৩২ সালে টনসিলে আক্রান্ত হয়ে তার একমাত্র পুত্র মারা যায়। এই শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই তার স্ত্রী দুই মেয়েকে নিয়ে তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। ছেলেকে হারিয়ে ফেলে এবং স্ত্রী-মেয়ের চলে যাওয়ায় পাগলপারা অবস্থা হয় তাঁর।

পরিবারকে ফেরানোর জন্য তিনি অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতে শুরু করেন। ভাল অর্থ উপার্জনের আশায় আবার আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। এক্সটেনশান ইউনিভার্সিটি থেকে আইনের ডিগ্রি নিয়ে আইন বিষয়ে প্র্যাকটিস শুরু করেন। কিন্তু এখানে এক মক্কেলের সাথে ঝামেলায়ে জড়িয়ে পড়ে এই চাকরিটিও ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। এরপর এক বিমা কোম্পানিতে যোগ দিলেও কিছুদিনের মধ্যে সেই চাকরিটিও চলে যায়।

১৯২০ সালে তিনি তাঁর সঞ্চিত কিছু অর্থ দিয়ে বোট কোম্পানি খুললেন।পাঁচটি নৌকা নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন।ইন্ডিয়ানার চেম্বার অব কমার্সে এরইমধ্যে একটা চাকুরি পেলেন, কিন্ত চাকুরিতে মন বসাতে না পারায় এক বছরের মাথায় এই চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। সিদ্ধান্ত নেন যে, বোট কোম্পানিটাও বিক্রি করে দেবেন। বাইশ হাজার ডলারে বোট কোম্পানিটি বিক্রি করে দিয়ে পাড়ি দিলেন কেন্টাকি রাজ্যে।

কেন্টাকিতে এসে একটা টায়ার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানে সেলসম্যানের চাকরীতে যোগদান করেন কিন্তু ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়।  কেন্টাকির স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গে তার ভালমতো আলাপ হয়ে গিয়েছিল। সেই লোকটির সহায়তায় একটি সার্ভিস স্টেশনে স্যান্ডার্স চাকুরি পেয়ে গেলেন । এই কোম্পানিটাও ১৯৩০ সালে বন্ধ হয়ে গেলে চল্লিশ বছর বয়সে কর্মহীন হয়ে পড়লেন স্যান্ডার্স।

চল্লিশ বছর বয়সে চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন। তাও তিনি হাল ছাড়েন নি। নিজের বাড়িতে রান্না করে সেই রান্না বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের মধ্যে সরবরাহ করা শুরু করেন। তিনি সার্ভিস স্টেশনের কর্মীদের জন্য রান্না করতেন। সেখানের কর্মীদের রান্নার মেনুতে একটি নতুন রেসিপি ভাজা মুরগির মাংস যোগ করেছিলেন। গভর্নর রুবি ল্যাফুন তার সুস্বাদু ভাজা মুরগির মাংস এতটাই ভালোবাসতেন যে তিনি হারল্যান্ড স্যান্ডার্সকে কেন্টাকির সম্মানসূচক কর্নেল নামে আখ্যায়িত করেন। এভাবেই তিনি কর্নেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

শেল অয়েল কোম্পানির পাশে থাকা ছোট একটি জায়গা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকেই তিনি খাবার বানানো শুরু করেন।  এই স্থানটির জন্য তাঁকে কোন ভাড়া দিতে হতো না, শুধুমাত্র  আয়ের একটা ছোট অংশ তাদেরকে দিলেই হত। স্যান্ডার্স সেখানে  নতুন নতুন খাবার তৈরি করতে শুরু করলেন।  চিকেন দিয়ে বানানো রেসিপি গুলির সাথে সাথে শহর জুড়ে স্টেকের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। স্যান্ডার্সের ব্যবসার উন্নতি ঘটতে থাকে। তার ব্যবসার রমরমা অবস্থা দেখে ম্যাট স্টুয়ার্ট নামে এক স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী স্যান্ডার্সের দোকানে হামলা শুরু করে ও তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য শুধুমাত্র যে হোটেলে হামলা করা হয়েছিল তাই নয়, এর সাথে তাঁর উপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান কিন্তু সেই গুলির আঘাতে শেল কোম্পানির এক কর্মীর মৃত্যু হয়।

এরপরও ভয় না পেয়ে তার যথাসাধ্য পুঁজি বিনিয়োগ করে ১৯৩৯ সালে নর্থ ক্যারোলিনার অ্যাশভিলে একটা মোটেল খুলেছিলেন। কিন্ত দুর্ভাগ্যক্রমে সেবছরেই নভেম্বরে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়। ফলস্বরুপ পুরো মোটেলটি পুড়ে ছাই হয়ে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়। অদম্য মনোবল নিয়ে সেই ধ্বংসাবশেষের জায়গায় একটা রেস্টুরেন্ট চালু করে ফেললেন। এই রেস্টুরেন্টটিতে স্যান্ডার্স শুরু করেন চিকেন ফ্রাইের এক ‘সিক্রেট রেসিপি’। চিকেন ফ্রাইের এই রেসিপিটি জনগনের কাছে পৌঁছানোর আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ভাগ্যের পরিহাসে এইবারও তিনি ব্যর্থ হন। স্যান্ডার্সকে হোটেলটা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।

১৯৫২ সালে তিনি কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন রেসিপিটি বানিজ্যকভাবে নিয়ে এলেন। শুধুমাত্র ফ্রায়েড চিকেন রেসিপিটি বিক্রির জন্য নতুন একটি রেস্তরাও খুললেন। এরপর নতুন এই রেসিপিটি খেয়ে দেখবার জন্য বহু লোকের লাইন লেগে গেল। এই রেসিপিটি লোকজন এত পছন্দ করতে লাগল যে বিক্রি করে তিনি কুলতে পারছিলেন না। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন KFC-র শাখা খোলার। প্রথমে আমেরিকায় KFC-এর শাখাটি খোলা হলেও আজ অবধি সারা বিশ্বের 115টি দেশ এবং অঞ্চলে 18,000টিরও বেশি KFC আউটলেট রয়েছে।

ব্যবসার রমরমা যে অনুপাতে বাড়ছিল ঠিক সেই অনুপাতে তার বয়সও বাড়তে থাকে। এই বয়সে কর্ণেল স্যান্ডার্সের একার পক্ষে সম্পূর্ণ ব্যবসাকে সামলানোর মতো অবস্থাও ছিল না। তাই ১৯৬৪ সালে KFC-র কিছু অংশের শেয়ার তার নামে রেখে বাকি অংশ ‘কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন কর্পোরেশন’-কে দুই মিলিয়ন ডলার দামে বিক্রি করে দেন। অবশ্য বলাবাহুল্য, তিনি KFC -র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসডর হলেন। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে KFC -কে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিতে শুরু করলেন। KFC-র  বিজ্ঞাপনের কাজের জন্য বছরে কয়েক লক্ষ মাইল ভ্রমন করেছেন। KFC-র বহু শাখায় নিজে গেছেন ও খাবারের মান যাচাই করেছেন। যদি কোন শাখায় গিয়ে খাবারের মান নিম্নমানের মনে হয়েছে তাহলে সেই শাখার কর্মকাণ্ডও বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার কখন কখন খাবারের গুনগত মান খারাপ মনে হলে সেই শাখাটি নগদ টাকায় নিজে কিনে নিতেন।

অবশেষে ১৯৮০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে নব্বই বছর বয়সে জীবনাবসান হয় কর্ণেল স্যান্ডার্সের। স্যান্ডার্স এমনই এক চরিত্র যিনি জীবনে কখন হার মানতে শেখেননি। জীবনে বহুবার ব্যর্থ হয়েছেন কিন্তু ভেঙ্গে পড়েননি। সফলতার জন্য জীবনের শেষ বয়স পর্যন্ত ছুটে গেছেন। জীবনটা থেমে থাকার নয়, হেরে গিয়ে হতাশায় আছন্ন না হয়ে নিজের সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলতে হবে। কর্ণেল স্যান্ডার্স বিশ্ববাসীর কাছে এক বিশাল বড়ো অনুপ্রেরনার নাম। তাই, জীবনে যদি কেউ প্রত্যাক্ষিত হয় ও বিপদে নিরুৎসাহিত হয় তাকে অবশ্যই কর্ণেল স্যান্ডার্সের জীবনী পড়তে হবে, যেখান থেকে তারা জীবনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরনা পাবে।